দিনাজপুর-ঢাকা মহাসড়কের পাশেই গড়ে ওঠেছে দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। শহরের ফুলবাড়ি বাসস্ট্যান্ডের কাছে গেলেই দেখা মিলে প্রাচীরঘেরা সবুজ প্রাঙ্গণ। ক্যাম্পাসের চারপাশে লেখা রয়েছে নানা ধরণের স্লোগান। দেশের উত্তরাঞ্চলের কারিগরি শিক্ষায় বড় ভূমিকা রাখছে দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলা সদরে ১৬টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করে। ২১ দশমিক ৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত তারই একটি হলো এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রথমে পুরকৌশল ও পাওয়ার টেকনোলজি বিভাগে মাত্র ৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু। এরপরে পর্যায়ক্রমে যন্ত্রকৌশল, তড়িৎকৌশল, স্থাপত্য ও অন্দর নকশা (ইন্টেরিয়র ডিজাইন) এবং কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ ছয়টি বিভাগ চালু হয়েছে।
বর্তমানে দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার ৭০০। ৫৫৫ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুমোদন থাকলেও রয়েছেন মাত্র ৩৫০ জন। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক কয়েকজন শিক্ষকও রয়েছেন।
মূল গেটের পরে দেখা মিলে বিশাল খেলার মাঠ। ছাত্রদের জন্য শহীদ আমিনুল ইসলাম ও কাজী নজরুল ইসলাম নামে দুটি হল আছে। এছাড়া ছাত্রীদের জন্য তাপসী রাবেয়া নামে একটি হল আছে।
শহীদ জাহাঙ্গীর মিলনায়তন, একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ল্যাবরেটরি, টিএসসি, শহীদ মিনার—সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসটা বেশ বড়। এছাড়া একটি রয়েছে ফুলের বাগান।
তত্ত্বীয় ক্লাসের পাশাপাশি ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য ছয়টি বিভাগের আলাদা ল্যাব আছে। কনস্ট্রাকশন শপ, প্লাম্বিং, সয়েল মেকানিকস, অটোডিজেল, পাওয়ার জেনারেশন, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশন, ওয়েল্ডিং, শিট মেটাল, ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং, ই-প্ল্যান ল্যাব, মাইক্রোপ্রসেসর ল্যাব, সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ল্যাব, নেটওয়ার্কিং ল্যাবসহ মোট ৩৬ টি পরীক্ষাগার রয়েছে।
পুরকৌশল বিভাগের ওয়ার্কশপ সুপার আরিফুল ইসলাম জানান, রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এখানকার সয়েল মেকানিকস ল্যাবে আসে মাটি পরীক্ষা করতে। আরিফুল নিজেও দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেই পড়েছেন। নিজের কলেজ নিয়ে তিনি গর্বিত।
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মানসুর নাদিম বললেন, ‘এখানে ল্যাবের সুবিধা বেশ ভালো। প্রতিটি ক্লাসে প্রজেক্টর আছে। পড়ালেখার পাশাপাশি আমি গেম ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের কাজ করছি।’
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার হার ৫ শতাংশের কম। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। ছাত্রীরা শতভাগ বৃত্তিও পেতে পারেন। সব বিষয়ে পাস করা সাপেক্ষে প্রত্যেক শিক্ষার্থী চার হাজার টাকা পান। অষ্টম সেমিস্টার, অর্থাৎ সমাপনী পর্বে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রশিক্ষণ কোর্স শেষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয় আট হাজার টাকা।
পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী,কুড়িগ্রাম,রংপুর, বগুড়া গাইবান্ধা,জয়পুরহাট থেকেও পড়ালেখা করতে দিনাজপুর পলিটেকনিকে আসেন শিক্ষার্থীরা। ডিপ্লোমা করে উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটে যান ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ডুয়েট) বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো দিনাজপুর পলিটেকনিকের ১৭ জন শিক্ষার্থী চীনের শিজিয়াজুয়াং শহরের হেবেই কলেজ অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়তে যান। সেই ১৭ শিক্ষার্থীর মাঝে একজন তাজমিন নাহার। চীন থেকে আর্কিটেকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজিতে পড়া শেষ করেছেন তিনি।
তাজমিন নাহার জানান, পড়ালেখার পাশাপাশি চীনা অপেরা, বিতর্ক, বক্তৃতা, চীনা শিল্প ও চিত্রাঙ্কন বিষয়েও দক্ষতা অর্জন করেছেন তিনি। দেশে ফিরে ২০২০ সালের শেষে সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডে সম্প্রসারণ প্রকল্পে যুক্ত হয়েছেন। ২০২২ সালের শেষে আবারও চীনে গিয়েছেন। এখন বৃত্তি নিয়ে চীনের হুবেইতে চায়না থ্রি গর্জেস ইউনিভার্সিটিতে পুরকৌশলে বিএসসি ডিগ্রি করছেন এ শিক্ষার্থী।
ডুয়েটে যন্ত্রকৌশলে দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ছেন শামীম মণ্ডল। গত বছর দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষ করেছেন তিনি।
শামীম বলেন, ‘এখন ডুয়েটে যাঁরা পড়েন, তাঁদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশই সম্ভবত আমাদের পলিটেকনিক থেকে আসা।’ বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রাক্তনদের যে একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে, আলাপ করলেই বোঝা যায়।
দিনাজপুর পলিটেকনিকের সাবেক শিক্ষার্থী মনোয়ার হোসেন এখন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা।
দিনাজপুর শহরের কাটাপাড়া এলাকায় হৃদয় ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বিভিন্ন বেকারি পণ্য প্রস্তুত করছে প্রতিষ্ঠানটি। ফুড ইঞ্জিনিয়ারসহ ৭০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন এখানে। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম। ১৯৯৬ সালে দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পুরকৌশলে পড়েছেন।
সাইফুল জানান, পড়ালেখা করে কিছুদিন চাকরির জন্য ঘুরেছেন। এরপর স্বল্প পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানে এখন ৭০ জন চাকরি করছেন।
এছাড়া ঢাকায় ট্রান্সফরমার তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তৈয়ুবুর রহমান। দিনাজপুর শহরে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং এসআরএ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছেন এখানকারই প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
শুধু পড়ালেখা নয়, খেলাধুলা-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ নিয়েও এগিয়ে রয়েছে দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সাংস্কৃতিক চর্চায় বড় ভূমিকা রাখছে ক্যাম্পাসের ভেতরের শহীদ জাহাঙ্গীর মিলনায়তন। এখানে বিভিন্ন সময়ে গণিত অলিম্পিয়াড, ফিজিকস অলিম্পিয়াডসহ নানা আয়োজন করা হয়। ক্যাম্পাসে আছে পলিটেকনিক সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট। নাচ-গান, কবিতা আবৃত্তিতে মাতিয়ে রাখেন তারা। আছে ডিবেটিং ক্লাব সোসাইটি, রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট কালচারাল ক্লাব।
দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বর্তমান অধ্যক্ষ ওয়াদুদ মণ্ডল বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। সরকারও কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। আগামী প্রজন্ম কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে দেশ গড়ার কাজে অংশীদার হবে, এ লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। শিক্ষক ও আবাসনসংকট রয়েছে। সেগুলো কাটানোর প্রক্রিয়া চলমান। একইসাথে ফুড প্রসেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালু করার প্রক্রিয়াও চলছে।’ তথ্য ও ছবি- প্রথম আলো
আপনাদের ক্যাম্পাসের তথ্য ও খবর প্রকাশ করতে এই ঠিকনায় মেইল করুন-newsdiploma@gmail.com